Mustard Cultivation – সরিষা চাষ করে কিভাবে চার গুণ ইনকাম করবেন, সরিষা চাষের পদ্ধতি, উন্নত মানের সরিষার বীজ, জলসেচ পদ্ধতি, খরচ বিস্তারিত জানুন।

মানুষ খাবারে বা তরকারিতে টেস্ট নিয়ে আসার জন্য নানান ধরনের মসলা বা তেল বা অন্যান্য উপকরণ দিয়ে থাকে। মানুষ চাই যে যখন কোন কিছু খাওয়া হয়, তখন যেন জিভে তা স্বাদ লাগে। অস্বাদ যুক্ত খাবার সকলের কাছেই প্রায় অরুচি। তাই খাবারের মধ্য স্বাদ নিয়ে আসার জন্য সরিষা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে থাকে। তাছাড়া সরিষায় প্রোটিন, ফ্যাট ভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ থাকে। যার শরীরের জন্য উপকারী।

সরিষা থেকে তৈরি হয় সরিষার তেল, ওই তেল আবার রান্নার কাজে লাগে, আচার তৈরীর কাজে লাগে, অনেকে আবার শরীরে মাখার জন্য ব্যবহার করে থাকে। সরিষার তেল চুলের জন্য অনেক উপকারি ( mustard oil hair benefits ) তাছাড়া সরিষাকে বেটে তরকারি তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। আবার সরিষার চাট করা হয়।

এইসব দিক লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সরিষার ব্যবহার বিভিন্ন দিকে হয়ে থাকে, তাই সারা বছর সরিসার চাহিদা দেশে-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় থেকে থাকে। তাছাড়া আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে প্রত্যেকটি ফ্যামিলিতে যদি কমপক্ষে চার যেন থেকে থাকে, সেই চারজনের রান্নার জন্য প্রতি মাসে কমপক্ষে দু’লিটার তেলের অবশ্যই প্রয়োজন হয়ে থাকে।

আর আপনারা জানেন যে বর্তমান বাজারেতে তেলের মূল্য কমপক্ষে ১৮০ টাকা থেকে ২২০ টাকার মতো। তাই সরি সরিষার চাহিদা যেমন রয়েছে সেগুলিকে চাষ করেও খুব ভালো মূল্য পাওয়া যেতে পারে। তাই এই পোষ্টের মাধ্যমে সরিষা চাষের পদ্ধতি থেকে শুরু করে ইনকাম কিরকম কি হবে সেই সম্পর্কে ডিসকাস করা হবে।

👉 সরিষার চাষের (Mustard Cultivation) সময়

সরিষা চাষ বিশেষত শীতের মরশুমের চাষ। সরিষা চাষের জন্য বীজ বপনের উপযুক্ত সময় হল বিশেষত অক্টোবর মাস। অক্টোবর মাসের শুরুর থেকে একেবারে শেষপর্যন্ত পুরো মাস ধরেই সরিষার বীজ বপন করা যায়।

👉 সরিষার জন্য উপযুক্ত জলবায়ু

সরিষা চাষের জন্য শুষ্কতা পূর্ণ হলে ভালো হয়। কেননা বেশি পরিমাণে আদ্রতা বর্ণ জলবায়ু শস্য চাষের পক্ষে প্রতিকূল অর্থাৎ অনুকূল নয়। সেই কারণেই তো এই চাষ শীতকালে করা হয়ে থাকে। তাছাড়া অধিক বৃষ্টিপাত যুক্ত জলবায়ু এই চাষের জন্য অনুকূল নয়। কারণ বেশি পরিমাণে কয়েকদিন ধরে জল হয়ে যদি জমি জলমগ্ন হয়ে যায় তাহলে গাছ জরকা লেগে মরে যায়। এই চাষ ১৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ২৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে ভালো হয়ে থাকে। তাই শীতকালই উপযুক্ত সময়।

👉 তিলের বীজ

সর্বপ্রথম আপনাকে সরিষার বীজ বাজার থেকে বা যেকোনো বীজ দোকান থেকে কিনে আনতে হবে। কেনার সময় অবশ্যই লক্ষ্য রাখবেন বেশি যেন উন্নত মানের ভালো উচ্চ ফলনশীল বীজ হয়ে থাকে। যেমন বাংলাদেশী টরি-৭, এসএস-৭৫, রাই-৫, টিএস-৭২ এবং ভারতে বি-৯, ঝুমকাঝুমকা, পাইয়োরিন-৪৪ ও ৪৫, এস-০১ ইত্যাদি।

কেনার পর সরিষার বীজগুলিকে জমিনে ছড়ানোর পূর্বে জলে বীজ শোধক ঔষধ মিশিয়ে বীজগুলিকে শোধন করে নিতে হবে।

এখন কথা হচ্ছে কত পরিমান জমিনে কি পরিমান বীজ প্রয়োজন হবে। মনে রাখবেন যদি আপনি এক হেক্টর জমিনে তে সরিষার চাষ করতে চান তাহলে ৭ কেজি থেকে ৮ কেজির মত সরিষার প্রয়োজন হতে পারে। এবং যদি আপনি এক বিঘা জমিনে তে সরিষার চাষ করতে যান তাহলে আপনার সরিষার বীজ ১ কেজি থেকে ১.২৫ কেজির মত পড়তে পারে।

👉 জমি প্রস্তুত ও বীজ বপন

সর্বপ্রথম আপনাকে জমি ঠিক করতে হবে যে কোন জমিটি সরিষার চাষের জন্য ভালো হবে। তবে বেলে মাটি যুক্ত অথবা দোআঁশ মাটি যুক্ত অথবা বেলে ও দোআঁশ উভয় মিশ্রিত জমিতে সরিষার ভালো হয়। এবং মাটির PH মান ৫-৮ হয়, তাহলেও তার সরিষার চাষের জন্য মোটামুটি খুব ভালো।

জমি নির্বাচন করার পর, চাইলে আপনি জমিনেতে জৈব সার হিসেবে গোবর, খোল ইত্যাদি ছড়াতে পারেন। তারপর জমিনেতে খুব ভালোভাবে জল দিয়ে ভর্তি করতে হবে। এরপর জমি যতক্ষণ না পর্যন্ত জল একবারে শুষে নিয়ে হালকা বাত বা জো না আসা পর্যন্ত ওই অবস্থাতেই রেখে দিতে হবে।

এরপর নাঙ্গল অথবা ট্রাক্টরের সাহায্যে ভালোভাবে জমিকে লাঙ্গল অর্থাৎ হাল করে নিতে হবে। প্রয়োজনে দুই থেকে তিনবার হাল করতে হবে, যতক্ষণ না মাটিটি হালকা মলায়েম হয় অর্থাৎ ঝরঝরা হয়। কেননা মাটি যদি বড় বড় চাপ চাপ হয়ে থাকে তাহলে তা বীজ থেকে অঙ্কুরদগম হয়ে গাছ ফুটতে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

কয়েকবার নাঙ্গল করার পর মাটি একেবারে ঝুরঝুরে হয়ে গেলে, আপনি চাইলে কোদাল দিয়ে জমিনের লম্বা বরাবর অথবা আড়ে বরাবর জোল অর্থাৎ রো টেনে নিতে পারেন। তাহলে জমিনে বীজ ছড়াতে এবং জল পাওয়ানোর সময় খুব সহজেই এই কাজগুলো করতে পারবেন।

এরপর, আপনি যে যে বীজ গুলি শোধন করে রেখেছিলেন সেগুলিকে মাঠে নিয়ে গিয়ে যোল বরাবর ছড়িয়ে দিতে হবে। চাইলে আপনি কোন যোল তৈরি না করেও সেগুলিকে পুরো জমিনেতে ছড়াতে পারেন।

এরপর কয়েক দিনের মধ্যেই দেখবেন সরিষার বীজগুলি অঙ্কুরোদগম হয়ে নতুন চারা গাছ বেরিয়ে আসবে। আর যদি ঠিকভাবে চারা গাছ না ফোটে, তাহলে আপনি সেই মুহূর্তে জমিনেতে একেবারে সামান্য পরিমাণে হালকা করে জল দিয়ে দিবেন। এরপরেও যদি না চারাগাছ ফোটে তাহলে পুনরায় কিছু সরিষার বীজ কে, যেই যেই জায়গায় চারা গাছ ফোটেনি অর্থাৎ ফাঁকা রয়েছে সেই জায়গাগুলোতে ছড়াতে পারেন।

👉 আগাছা পরিষ্কার

জমিনে আপনি যে কোন চাষী করুন না কেন, আপনার বোনা ফসল ছাড়াও অগণিত নানা ধরনের অবাঞ্ছিত আগাছা জমিনেতে জন্মিয়ে থাকে। আর এই আগাছাগুলোকে যদি পরিষ্কার করা না হয় তাহলে সরিষার গাছকে বৃদ্ধি হতে বাধা প্রাপ্ত করে। তাই অবশ্যই চারা গাছ বেরোনোর ১৬ থেকে ২২ দিনের মাথায় অবশ্যই ছোট ছোট কোদাল দিয়ে আগাছা পরিষ্কার এর মাধ্যমে চারা গাছের গোড়ায় নাড়া দিতে হবে। এর ফলে জমিনের আগাছা যেমন পরিষ্কার হবে তেমনি গাছের গোড়াও ঢিলা হবে, এর ফলে গাছের শিকড় কে বৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করবে। এবং গাছকেও পুষ্টিকর হতে সাহায্য করবে।

👉 জলসেচের পরিমাণ

সরিষার যেহেতু একটি শুষ্ক আবহাওয়ার ফসল, তাই এই চাষের জন্য জলের খুব বেশি একটা জলের প্রয়োজন হয় না। মাত্র দুই থেকে তিনটি জল সেচের মাধ্যমেই এই ফসল চাষ করা যায়। তবে যদি সময় সময়ে বৃষ্টি হয়ে যায় তাহলে হয়তো কোন জলসেচের প্রয়োজন হবে না। সময় অনুযায়ী জল সেঁচেরর লিস্ট নিম্নরূপ দেওয়া হল।

  • বীজ বাপনের পর যদি সম্পূর্ণ জমিতে খুব ভালোভাবে সরিষার গাছ না জন্মায়, সে ক্ষেত্রে একদম হালকা করে প্রথম সেচ দেওয়া যেতে পারে। তবে চারাগাছ যদি ভালোভাবে জন্ম নিয়ে যায় তাহলে এই সেচের প্রয়োজন হবে না।
  • এরপর আগাছা পরিষ্কারের মাধ্যমে জমিনে কোদাল দেয়ার পর অর্থাৎ ২৫ দিন থেকে ৩০ দিনের মাথায়। একটা সেচ দিতে হবে।
  • এরপর সরিষার গাছ বড় হয়ে যখন ফুল আসবে। সেই সময় খুব ভালো করে একটি সেচ দিতে হবে।
  • এরপর ফুল থেকে ফল ধরার কয়েক দিনের মধ্যেই আরেকবার জল সেচ দিতে হবে। যাতে দানা গুলি মোটা এবং পরিপুষ্ট হয়।

তবে অবশ্যই এই কথাটা মনে রাখবেন। জমিনেতে জল সেচ দেওয়ার পর একদিনের বেশি যেন জমিনেতে জল দাঁড়িয়ে না থাকে। কারণ এতে সরিষার গাছগুলি জোরকা লেগে মরে যেতে পারে। তাই জল সেচের ব্যাপারে সব সময় সচেতন থাকতে হবে।

👉 সার ও কীটনাশক প্রয়োগ

সার প্রয়োগ – জমিনেতে জল পাওয়ানোর পূর্বে চাইলে গোবর ছড়াতে পারেন। এরপর জমিনে যখন লাস্ট লাঙ্গলটি হবে তখন চাইলে আপনি হালকা পরিমাণে ইউরিয়া সার ছড়িয়ে দিতে পারেন, এতে করে বীজ থেকে চারা গাছ জান্নাতে সাহায্য করবে। এরপর জমি নিয়ে আগাছা নির্মূলের পর অর্থাৎ কোদাল দিয়ে গাছের গোড়া ঢিলা করার পর হালকা জল সেচ দিয়ে তাতে কম পরিমাণে ইউরিয়া সার দিতে পারেন। এরপর যখন গাছে ফুল আসবে তখন এবং ফল ধরার সময় হালকা করে সমপরিমাণ ইউরিয়া সার দিতে হবে। তবে অবশ্যই মনে রাখবেন বেশি পরিমাণে সার যেন না পড়ে। এতে করে গাছ ঝিমিয়ে যায়।

কীটনাশক বিষ প্রয়োগ – যদি পাতা শুকনো, গাছ ছিমে যাওয়া, বা অন্য কোন কিটের উপদ্রব হয়। সেক্ষেত্রে আপনি যে কোন কীটনাশক বিষ প্রয়োগ করতে পারেন। যা আপনারা কীটনাশক ঔষধ দোকানে গেলেই পেয়ে যাবেন। আর জমিনেতে যদি লাদা পোকা লাগে, সেক্ষেত্রে বিষ দোকান থেকে কীটনাশক বিষ নিয়ে এসে নাদা গুড় অথবা ভাঙা চালের সঙ্গে মিশিয়ে সেটিকে জমিনেতে ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে করে লাদা পোকাগুলি ওগুলি খেয়ে মরে যাবে। কেননা সেগুলোর সঙ্গে বিষ মিশানো থাকবে এই কারণে। তবে ভাঙ্গা চালের সঙ্গে গুড় মিশিয়ে তার সঙ্গে বিষ মিশ্রিত করে ছড়ালে আরো বেশি কাজ হয়।

👉 ফসল তোলা ও সরিষা পাওয়া

ফসল কাটা – ফসল বোনার পর ৭৫ দিন থেকে ১০০ দিনের মধ্যে সরিষা ফসল কাটার জন্য উপযুক্ত হয়ে যায়। ফসল কাটার দিন সংখ্যা নির্ভর করে বীজের জাতের ওপর। তবে অবশ্যই মনে রাখবেন যখন সরিষা গাছ, পাতা এবং শুটিগুলি হলুদ রঙের হয়ে যাবে । তখনই আপনার সরিষার ফসল তোলার জন্য উপযুক্ত হয়ে যাবে। যদি আপনি বেশি দিন অতিবাহিত করেন তাহলে শুটিগুলি ফেটে গিয়ে ভেতর থেকে সরিষা ঝরে মাটিতে পড়ে যাবে। তাই উপযুক্ত সময় হলে আপনাকে সরি ছাড়া গাছগুলিকে কেটে নিতে হবে।

সরিষা পাওয়ার পদ্ধতি – সরিষার গাছগুলিকে কেটে নেয়ার পর। তিন থেকে চার দিন রোদে দিতে হবে। এবং প্রত্যেকদিন রোদ লাগার পর বিশেষত বিকেল বেলা ডাং বা লাঠি নিয়ে হালকা করে মেরে। সরিষার দানা গুলিকে শুটি থেকে ঝরিয়ে নিতে হবে। এরপর ওই সরিষার দানা গুলির সঙ্গে অনেক আবর্জনা থাকতে পারে, আপনাকে ওগুলিকে ছোট ছিদ্রের জাল নিয়ে চেলে বা পরিষ্কার করে নিতে হবে। এরপর সরিষা গুলো বস্তায় ভরে আপনি বিক্রি করতে পারেন।

👉 সরিষার ফলন

বিভিন্ন সরিষার জাতের ফলন প্রতি হেক্টরে বিভিন্ন কুইন্টাল হয়ে থাকে। তবে গড়ে আপনারা প্রতি হেক্টরে ১১.৫ কুইন্টাল থেকে ১৪ কুইন্টাল পর্যন্ত পেয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে হাইব্রিড সরিষাগুলো একটুকু বেশি ফলন দেয়।

👉 খরচ

একটি গবেষণার রিপোর্টে জানা গিয়েছে যে, যদি এক হেক্টর জমিনেতে সরিষা চাষ ( Mustard Cultivation ) করতে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মত খরচ হয়। তবে আপনি চাইলে রবি মৌসুমীর তিল চাষের জন্য ইনস্যুরেন্স করতে পারেন। এর ফলে যদি আপনার বন্যা বা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চার্জ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে হয়তো আপনি ভর্তুকি পেয়ে যাবেন।

👉 এই চাষে কি কি বিষয়ে মাথায় রাখবেন

  • উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড জাতীয় সরিষার চাষ করবেন, যাতে বেশি পরিমাণে ফসল পান।
  • চাষের জন্য সরকার কৃষি মন্ত্রক দ্বারা নির্দেশিত বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করে সরিষার চাষ করতে হবে।
  • জমিনেতে জল যাতে একদিনের বেশি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন, প্রয়োজনের জল নিকাশির ব্যবস্থা রাখবেন।
  • জমিনের উর্বরতা বাড়ানোর জন্য চাষের পূর্বে গোবর এবং অন্যান্য জৈব সার ব্যবহার করতে পারেন।
  • জমিনেতে পোকা, মাছি বা ধসা লাগলে প্রয়োজনমতো তার পরিচর্যার ব্যবস্থা করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *