pot making -মাটির জিনিসপত্র তৈরির ব্যবসা, কিভাবে তৈরি করবেন, কি কি কাঁচামাল ও সরঞ্জামের প্রয়োজন, তৈরি করে কিভাবে বিক্রি করবেন জানুন বিস্তারিত।
আমরা আজকাল আমাদের আশেপাশে যে সমস্ত জিনিস দেখতে পায় তা যেকোনো ধরনের ধাতু দিয়েই তৈরি হওয়া দেখতে পাই। বাসন বা বাটি বা গ্লাস বা হাড়ি বা কলসি ইত্যাদি হয় অ্যালুমিনিয়াম, পিতল বা কাঁসার তৈরি।
কিন্তু যদি আমরা ৮০-৯০ বছর পিছিয়ে যায় সেই মুহূর্ত থেকে তার পূর্ব সময়গুলোতে মাটির তৈরি যে কোন আসবাবপত্রই বেশি ব্যবহৃত হত। কেননা সেই সময় বিভিন্ন ধাতুর তৈরি আসবাবপত্রের ব্যবহার খুব কমই ছিল। এর কারণ ছিল ধাতুর তৈরি আসবাবপত্রের ব্যবহার কম। ব্যবহার হলেও তা সাধারন মানুষের সাধ্যের বাইরে ছিল।
এমনকি আরও যদি আমরা পিছিয়ে যায় তাহলে দেখতে পাবো, যে শুধুমাত্র মাটির আসবাবপত্রই কিন্তু প্রধানত ব্যবহার করা হতো। ধীরে ধীরে বিজ্ঞান যত উন্নতি করতে লাগলো, ততই বিভিন্ন ধাতুর তৈরি বিভিন্ন কাজে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসপত্র আবিষ্কার হতে লাগলো। এবং ধীরে ধীরে মাটির তৈরি আসবাবপত্রের গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে কমতে লাগলো।
কারণ মাটির তৈরি আসবাবপত্র টেকসই নয়। হাত থেকে একবার পড়ে গেলেই তা কিন্তু ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। এবং এগুলি ওজনে খুব ভারী ছিল। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা নিয়ে যেতে খুবই অসুবিধা বোধ হতো। কিন্তু সেই জায়গায় ধাতুর তৈরি জিনিসপত্র ছিল টেকসই এবং হালকা।
যদিও ধাতুর তৈরি আসবাবপত্রের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে, তবুও কিন্তু মাটির তৈরি আসবাবপত্রের চাহিদা এখনো কিন্তু ভালোই বজায় রয়েছে। কেননা বর্তমানে আপনি লক্ষ্য করেছেন বেশিরভাগ চা মাটির তৈরি কাপ এতেই প্রদান করা হয়ে থাকে। কারণ এতে নাকি চায়ের স্বাদ অনেকটা বেড়ে যায়। তাছাড়া মাটির তৈরি কলসি বা হাড়িতে জল রাখলে, জল কিন্তু অন্যান্য ধাতুর তুলনায় অনেকটাই ঠান্ডা থাকে। এবং মাটির তৈরি জিনিস এ খাবার খেলে বা খাবার রাখলে তা শরীরের ওপর কোন খারাপ প্রতিক্রিয়া ফেলেনা। অপরদিকে নানান ধাতু কিন্তু শরীরের পক্ষে নানান ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে । যেমন প্লাস্টিকের তৈরি আসবাবপত্র।
তাছাড়া ঘর সাজানোর জন্যও কিন্তু মানুষ মাটির তৈরি নানান ডিজাইনের বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র কিনে থাকে। যাই হোক এই সমস্ত দিকগুলিকে লক্ষ্য রেখে মানুষের মধ্যে মাটির তৈরি আসবাবপত্রের চাহিদা আগের মতই বহাল রয়েছে। নিম্নে মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরীর ব্যবসার আইডিয়া সম্পর্কে ডিসকাস করা হলো।
👉 বাজার গবেষণা
সর্বপ্রথম আপনাকে বাজার গবেষণা করে দেখতে হবে। বাজারেতে কোন কোন মাটির পাত্রের চাহিদা সবচেয়ে বেশি এবং কোন কোন মাটির পাত্র সবচেয়ে বেশি এবং ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে। আপনাকে ওই সমস্ত মাটির জিনিসপত্রই বেশি করে তৈরি করতে হবে।
👉 প্রয়োজনীয় কাঁচামাল
মাটির জিনিসপত্র তৈরি করতে আপনার খুব বেশি কাঁচামালের প্রয়োজন হবে না। এর জন্য প্রধান যে কাঁচামাল তাহলো কাদামাটি। মাটিটা এঁটেল ও বালিযুক্ত হলে সবচেয়ে ভালো। মাটি তো আপনি যথেষ্ট পরিমাণে পেয়ে যাবেন। তবে আপনি চিনামাটির জিনিসপত্র তৈরি করতে হলে, এই মাটি আপনাকে নির্দিষ্ট স্থান থেকে কিনে আনতে হবে।
দ্বিতীয় যে কাঁচামালটি লাগবে তা হল রং। আপনি যদি জিনিসপত্র গুলিতে নানান ধরনের ডিজাইন অনুযায়ী রং লাগাতে চান, সেক্ষেত্রে আপনাকে বিভিন্ন ধরনের রং কিনতে হবে।
👉 প্রয়োজনীয় মেশিন ও জিনিসপত্র
আগে কুমোররা হাতে ঘোরানো চাকার উপরে মাটিকে বসিয়ে, হাতের সাহায্যে চাকাকে ঘুরিয়ে মাটির বিভিন্ন আকার দিয়ে নানান জিনিসপত্র তৈরি করত। কিন্তু এই কাজটি খুবই কষ্টসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এতে কষ্ট ও সময় তো যেতই সঙ্গে খুবই কম পরিমাণে জিনিসপত্র সারাদিনে তৈরি করা যেত। কিন্তু বর্তমানে একটি মেশিন বাড়িয়েছে, যেটিকে হাত দিয়ে ঘোরানোর আর প্রয়োজন হবে না। নিচে মেশিনটি উল্লেখ করা হল –
ইলেকট্রিক চাক বা পটারি হুইলস ( Pottery Wheel )- এটি এক ধরনের ইলেকট্রিক চাকা যেদিকে বিদ্যুৎ সংযোগ করলেই অটোমেটিক্যালি ঘুরতে থাকে। তবে অনেক চার্জিং পটারি হুইলসো পাওয়া যায়। এগুলিতে চাকা ঘোরানোর গতি কমানো ও বাড়ানো যায়। এর মাঝে সমতল একটি চাকি থাকে, যার উপরে কাদামাটি রেখে বিভিন্ন আকারের জিনিসপত্র তৈরি করা যায়। আপনারা এগুলি অনলাইনে সার্চ করলে পেয়ে যাবেন Pottery Wheel লিখে।
চুল্লি বা ভাটি ( Furnace ) – এটি মাটির তৈরি জিনিসপত্র গুলিকে পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। আপনারা চাইলে ইলেকট্রিক চুল্লিও কিনতে পারেন। মাটির তৈরি কাঁচা জিনিসপত্র গুলিকে চুল্লির ভেতরে রেখে ইলেকট্রিক সংযোগ করলেই, মাটির পাত্রগুলি পোড়া হয়ে যাবে।
তবে আপনি যদি এটি কিনতে না চান তাহলে নিজে থেকেও একটি গর্ত করে সেখানেতে চুল্লি বা Furnace তৈরি করতে পারেন। এতে করে ইলেকট্রিক চুল্লি কেনার খরচা কমে যাবে। তবে এর জন্য আপনাকে আলাদাভাবে একটু বেশি পরিশ্রম করতে হবে। আপনি অনলাইন যদি সার্চ করেন “মাটি পোড়ানোর চুল্লি” তাহলে হয়তো অনেক ভিডিও টিউটোরিয়াল পেয়ে যেতে পারেন। যে কিভাবে চুল্লি তৈরি করে, মাটির তৈরি জিনিসপত্র পড়ানো হয়। একবার গর্ত করে একটি চুল্লি করলে সেটি বহু বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে।
তবে আপনি যদি একেবারে ছোট আকারের মাটির পাত্র তৈরীর কাজ শুরু করতে চান, তাহলে আপনার মেশিনগুলি না কিনে, চাকা এবং নিজের চুল্লি তৈরি করে কাজ করাই উত্তম হবে। বড় আকারের মাটির জিনিসপত্র তৈরীর ব্যবসা করতে চাইলে আপনি এগুলো অবশ্যই কিনবেন।
👉 প্রশিক্ষণ
মাটির তৈরি জিনিসপত্রের কাজ এতটা সহজ কাজ নয়। এর জন্য খুব ভালো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। তা না হলে আপনি কোন জিনিসের আকার বা নকশা দিতে পারবেন না। আপনি যদি মাটির জিনিসপত্র তৈরি করতে না জানেন, তাহলে যারা কুমোর অর্থাৎ মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে, তাদের কাছ থেকে আপনাকে ভালোভাবে প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
👉 কর্মি নিয়োগ
আপনি যদি নিজে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করতে পারেন বা বা প্রশিক্ষণ নিয়ে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করছেন। সেক্ষেত্রে কাদা-মাটি ছানা, জিনিসপত্রকে রোদে নিয়ে গিয়ে দেওয়া, ভাটি বা চুল্লিতে গিয়ে পোড়ানো ইত্যাদি কাজ কর্মের জন্য এক থেকে দুই জন লোক হলেই চলবে।
তবে আপনার বাড়িতে যদি দুই থেকে তিনজন ব্যক্তি থেকে থাকে সেক্ষেত্রে আপনার লোক রাখার আর প্রয়োজন হবে না। আর যদি আপনি কাজগুলো মেশিনের সাহায্যে করেন তাহলে সে ক্ষেত্রেও আপনার কর্মী নিয়োগের খুব একটা প্রয়োজন হবে না। তবে বড় আকারের করতে চাইলে এবং নিজে কাজ না করতে চাইলে সে ক্ষেত্রে আপনাকে কর্মী নিয়োগ করতে হবে।
👉 মাটির আসবাবপত্র তৈরির পদ্ধতি
প্রথম – সর্বপ্রথম আপনাকে কাদামাটি গুলিকে হাতে অথবা পায়ে করে ছেনে ছেনে মোলায়েম করতে হবে। এর সঙ্গে দেখতে হবে কাদামাটির মধ্য কোন ছোট বড় মার্বেল বা পাথর রয়েছে নাকি। যদি থাকে সেটিকে বাদ দিতে হবে।
দ্বিতীয় – পটারি হুইলস বা হাতে ঘোরানো চাকার মিডিলের চাককিতে কাদামাটিটিকে রেখে মেশিন কে চালু করে দিতে হবে বা হাতে চালিত হলে চাকাটিকে ঘুরাতে হবে।
তৃতীয় – এরপর চাকাটি ঘুরতে থাকবে আপনাকে হাতের সাহায্যে কাদা মাটিটিকে যেকোনো আসবাবপত্রে রূপ দিতে হবে। বাসন বানাতে চাইলে বা বাটি বা কলসি বানাতে চাইলে হাতের সাহায্যে এটিকে রূপ দিতে হবে।
চতুর্থ – বাটি বা কলসি বা গ্লাস বা বাসন তৈরি হয়ে গেলে একেবারে নিচে সরু তার দিয়ে চাককি থেকে আসবাবপত্রটিকে কেটে আলাদা করে সেটিকে অন্য সাইডে রেখে দিতে হবে।
পঞ্চম – এরপর যা যা মাটির তৈরি জিনিস আপনি তৈরি করবেন সেগুলিকে রোদেতে শুকিয়ে নিতে হবে।
ষষ্ঠ – রোদেতে ভালোভাবে শুকিয়ে যাওয়ার পর এগুলিকে ভাটি বা চুল্লিতে পুড়ে নিতে হবে।
সপ্তম – তারপর আপনি যদি কোন কালার করতে চান, তাহলে সেই রং নিয়ে আপনাকে পালিশ করতে হবে। এরপর আপনার মাটি তৈরি আসবাবপত্রটি বিক্রির জন্য উপযুক্ত হয়ে যাবে।
👉 বিক্রি
আপনি মাটির তৈরি জিনিসপত্র গুলিকে বাজারে গিয়ে বিক্রি করতে পারেন। বিশেষত যেই যেই দিন হাট বসে, সেই দিন বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, তাই ঐদিন বাজারে বিক্রি করতে যেতে পারে।
এছাড়া গ্রামে গ্রামে গিয়ে আসবাবপত্র গুলি বিক্রি করতে পারেন। অথবা কোন একটি জায়গায় মাটির আসবাবপত্রের দোকান খুলতে পারেন। অথবা পাইকারি ভাবে আপনি অন্যান্য দোকানদের কেউ বিক্রি করতে পারেন।
বা বর্তমানে অনেক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। সেগুলিতে অ্যাকাউন্ট বানিয়ে মাটির তৈরি জিনিসগুলিকে অনলাইন বিক্রি করতে পারেন।
👉 খরচ
খরচ – এর জন্য প্রধান যে কাঁচামাল কাদামাটি তা আপনি নিজে থেকেও সংগ্রহ করতে পারেন। বা আপনি কিনতেও পারেন, তবে এর মূল্য খুব একটা বেশি পড়বে না। প্রধান যে খরচ হবে তা হল আপনার পটারি হুইলস মেশিন ও ভাটি বা চুল্লিতে। পটারি হুইলস মেশিন এটি উন্নত মানের কিনতে গেলে ২০,০০০ টাকার মত খরচ হবে, তবে চুল্লি বা ভাটি কেনার প্রয়োজন নাই আপনি এটি নিজেও তৈরি করতে পারবেন। অর্থাৎ সবমিলিয়ে আপনার কাছে যদি ৩০,০০০ টাকা থাকে তাহলে আপনি এই ব্যবসা খুব ভালোভাবে শুরু করতে পারবেন।