Onion Cultivation – পেঁয়াজ চাষের পদ্ধতি, চারাগাছ তৈরি, জমি তৈরি, রোপন পদ্ধতি, সার ও বিষ প্রয়োগ, ফসল তোলার সময়, খরচ সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন।

Onion Cultivation

পেঁয়াজ নিত্য প্রয়োজনীয় একটি জিনিস। আমাদের খাবারের সঙ্গে এটি অতপ্রত ভাবে জড়িত। যেকোনো রান্নাবান্নার কাজে কিন্তু পেঁয়াজ লেগে থাকে। এমন কোন তরকারি নাই, যে তাতে পেঁয়াজ লাগে না। এছাড়া পেয়াজের সাহায্যে নানান ধরনের চাটনি করা হয়ে থাকে। আবার অনেক মানুষ পেঁয়াজ মুড়ি দিয়ে খেতে পছন্দ করে।

এইসব দিক বিচার করে দেখলে, পেঁয়াজের চাহিদা সব দিনই থাকবে। তাই পেঁয়াজের চাষ করলে খুব ভালো উপকার হবে।

🧑‍🌾 পেঁয়াজ চাষের পদ্ধতি

পেঁয়াজ চাষ করার জন্য প্রথমে আপনাকে পেঁয়াজের চারা তৈরি করতে হবে। তারপর সেই চারাকে তুলে পুনরায় সেগুলিকে রোপন করতে হবে। প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে পেঁয়াজের চারা কিভাবে তৈরি করতে হয়। তারপর এর নিম্নে রোপনের পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে।

✍️ পেঁয়াজের চারা গাছ তৈরির পদ্ধতি

প্রথম – সর্বপ্রথম আপনাকে বীজ দোকান থেকে ভালো ও উন্নতমানের পেঁয়াজের বীজ কিনে আনতে হবে।

দ্বিতীয় – এরপর জমিতে আপনাকে জল পাইয়ে নিতে হবে। তারপরে জমিনের জল যখন শুষে নেবে, তার এক-দুই দিনের মধ্যে জমিনেতে নাঙ্গল দিতে হবে। চাইলে আপনারা পরপর দুইবার একই দিনে লাঙ্গল দিয়ে দিতে পারেন, যাতে করে মাটিটা খুব ভালো চূর্ণ হয়।

তৃতীয় – এরপর যে জায়গায় আপনি বীজ ফেলবেন সেই জায়গার সমস্ত আগাছা ভালোভাবে বেছে নিবেন। যাতে বীজের অঙ্কুরোদগম হয়ে বেরিয়ে আসতে সমস্যা না হয়।

চতুর্থ – এরপর যে বীজগুলি আপনি কিনে এনেছিলেন সেগুলিকে দু ঘন্টা থেকে চার ঘন্টা পর্যন্ত রোদেতে দিয়ে দিবেন। এরপর জল দিয়ে কোন একটি পাত্রে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে, পরিষ্কার করার পর ওই পাত্রেই জল দিয়ে বীজগুলিকে ১২ ঘন্টা থেকে ১৮ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে।

পঞ্চম – এরপর চাইলে আপনারা জমিনেতে গোবর অথবা বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সারও আপনারা ব্যবহার করতে পারেন। যেমন প্রতি পাঁচ শতাংশ অর্থাৎ পাঁচ ডেসিমেল জায়গাতে – ৪ কেজি ডি.এ.পি, ৩ কেজি পটাশ, জিবাসম ১.৫ – ২ কেজি, জৈব সার ২ কেজি দিতে পারেন।

ষষ্ঠ – জমিনেতে সার গুলি দেওয়ার পর আপনারা ভিজিয়ে রাখা পেঁয়াজের বীজগুলিকে উপরেতে ভালোভাবে ছড়িয়ে দিবেন, যেমনটা ধানের চারা গাছ তৈরির জন্য বীজ ছড়াতে হয়।

সপ্তম – পেঁয়াজের বীজগুলিকে ছড়িয়ে দেওয়ার পর কলাগাছের অথবা মোটা বাঁশ নিয়ে মাটির উপরের তলটিকে সমান করে দিবেন। এতে করে বীজগুলিও হালকা মাটির আড়ালে হয়ে যাবে এবং বীজের অঙ্কুরোদগম হতেও সুবিধা হবে।

অস্টম – এরপরে সাধারণত ৩-৫ দিনের মধ্যেই দেখবেন বীজ থেকে চারা গুলি অঙ্কুরোদগম হয়ে উপরে বেরিয়ে আসবে। তারপর যখন দেখবেন চারাগুলি এক চাকর বা ৬ থেকে ৭ ইঞ্চির মত হয়ে গিয়েছে তখন সেগুলি রোপনের জন্য উপযুক্ত হয়ে যায়।

✍️ চারাগাছ রোপনের পদ্ধতি

⛏️জমি তৈরি ও রোপন

প্রথম – আপনাকে পুরো জমিনেতে জল পাইয়ে নিতে হবে। এরপর জমিনের জল একেবারে যখন শুকিয়ে যাবে অর্থাৎ জমিতে বাত বা জোত আসবে, তখন জমিনেতে ট্রাক্টর বা পার্টিলারের সাহায্যে পরপর দুইবার হাল বা নাঙ্গল করে নিতে হবে। মনে রাখবেন প্রথমবার যেই দিকে নাঙ্গল করবেন দ্বিতীয়বার তার বিপরীত দিক দিয়ে নাঙ্গল করবেন অর্থাৎ একবার লম্বা ভাবে এবং দ্বিতীয়বার আড় ভাবে। এতে করে মাটি আরো ভালো চূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

দ্বিতীয় – এরপর আপনি চাইলে যথাসম্ভব যদি কোন আগাছা থাকে সেগুলিকে উপরের স্তর থেকে বেছে নিবেন। এতে করে পরবর্তীকালে কম আগাছা হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।

তৃতীয় – এরপর এক কাঠা পিছু অর্থাৎ ২ ডিসমাল পিছু এক কেজি করে ইউরিয়া এবং পটাশ দিয়ে দিবেন। চাইলে আপনারা আরো অন্যান্য স্যার দিতে পারেন। এরপর জমিনের ওপরের ভাগ মই দিয়ে সমান করে নিবেন।

চতুর্থ – এরপর যেই চারা গাছ আপনি রোপনের জন্য তৈরি করেছিলেন, সেগুলিকে ওই জায়গা থেকে তুলে নিতে হবে। এবং বজা করে বেঁধে, যেই জায়গায় আপনি রোপন করবেন, সেখানে নিয়ে যেতে হবে।

পঞ্চম – এরপর পুরো জমিটিকে আরী বা আঞ্জি দিতে হবে। মনে রাখবেন আরী বা আঞ্জি দেওয়ার সময়, তার সাইটে যেন হালকা করে নালার মত থাকে, যাতে করে জল পাওয়ানোর পর সেগুলি জমির উপরেতে সব সময় জমে না থেকে কিছু সময় পর যেন ওই না লাগিয়ে জমে থাকে। কেননা বেশি সময় ধরে জল জমে থাকলে পেঁয়াজ যারা গাছে পচন লাগতে পারে। এবং যাতে করে সার এবং বিষ দেওয়ার জন্য ওই আরী বা আঞ্জির সাইড দিয়ে চলাফেরা করা যায়।

অথবা, পুরো জমিনে তে যেভাবে বাদাম লাগানো হয় ওইভাবে রেটি টেনে, ওই রেটির উপর বরাবর পেঁয়াজ চারা গাছ লাগাতে পারেন। এতে আরো অনেক ভালো হবে এবং সুবিধা হবে পেঁয়াজ চারা গাছ লাগানোর জন্য। এর ফলে পেঁয়াজের চারাগাছগুলো রেটির ওপরে লাগানো থাকার কারণে কিছু সময়ের মধ্যেই জলগুলি রেটির নিচে নেমে যাবে। এবং পিঁয়াজের চারা গাছগুলি জেগে থাকবে উঁচুতে থাকার কারণে।

ষষ্ঠ – পেঁয়াজ চারা গাছ রোপনের সময় মনে রাখবেন চারা থেকে চারা দূরত্ব যেন পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি হয়ে থাকে। অর্থাৎ এক হাত জায়গায় চারটা করে চারা গাছ লাগাতে পারেন।

🚰 রোপনের পর জলসেচ

চারা গাছ লাগানোর ৪-৫ দিনের ভিতরে হালকা একটা জল সেচ দিয়ে দিবেন। দ্বিতীয়বার পুনরায় ২৫ থেকে ৩০ দিনের মাথায় আপনাকে আরেকটি শেষ দিতে হবে। এসেছে সঙ্গে চাইলে আপনারা হালকা প্রয়োজনীয় যেকোনো রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে পারেন।

⛏️ আগাছা পরিষ্কার

চারা গাছ রোপনের ৮ থেকে ১০ দিনের মাথায় আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। তবে অনেকে চারাগাছ লাগানোর পূর্বে নানান ধরনের আগাছা নাশক ব্যবহার করে থাকে। আপনি চাইলে করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে আপনাকে আরো ১০ থেকে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে, চারা গাছের রোপণের জন্য। কেননা এর প্রভাব চারা গাছের উপর উড়তে পারে ।

🧑‍🌾 কীটনাশক

মরিচা রোগ – পাতায় যদি হলুদ রঙের মরিচা রঙ পড়ে তাহলে thunder প্রতি লিটারে ২ গ্রাম এবং Trichoderma viridi 6 গ্রাম প্রতি লিটার জলে একসঙ্গে গুলে স্প্রে করতে হবে। অথবা Tata Master প্রতি লিটারে দুই থেকে আড়াই গ্রাম করে জলে গুলেও স্প্রে করতে পারেন।

লেদা পোকার উপদ্রপ – লেদাপোকা গুলি গাছের পাতা গুলি খেয়ে খেয়ে একেবারে গড়া পর্যন্ত পৌঁছে যাবে, এবং গড়াতে পচন ধরাতে সাহায্য করবে। তাই লেখাপড়া মারার জন্য profex super প্রতি লিটার জলে ১ মিলি গুলে স্প্রে করতে হবে। অথবা Missile বা EM-১ প্রতি লিটার জলে হাফ মিলি করে গুলে স্প্রে করতে পারেন।

ইয়ার উইংস এর উপদ্রপ – এটি কালো ধরনের ছোট ছোট পোকা। যেগুলি পেঁয়াজের গোড়ার কাছ থেকে ফুটো করে পেঁয়াজের ভেতরে তে প্রবেশ করে। এবং পেঁয়াজের ভেতরের অংশটিকে কুরে কুরে খেয়ে পিঁয়াজটিকে পচিয়ে দেয়। এই পোকা মারার জন্য প্রথমেই জমিনেতে শেষ লাঙলের পর দানা বিষ ছড়াতে হবে। ছড়ানোর পরেও গাছ লাগানোর পরে যদি লাগে তাহলে dasban, koroban, dhanushban এগুলি জলে গুলে প্রয়োগ করতে হবে, যেন গাছের গোড়া ভিজে এমন ভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

☁️ পেঁয়াজ চাষের জলবায়ু

পেঁয়াজ চাষের জন্য নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর প্রয়োজন। পেঁয়াজ চাষের জন্য তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি থেকে ২৬ ডিগ্রি থাকলে খুবই ভালো। তবে ঘন ঘন বৃষ্টি ও অত্যাধিক তাপমাত্রা পেঁয়াজ চাষের জন্য উপযুক্ত নয়।

👩‍🌾 পেঁয়াজ চাষে মাটি

সাধারণত সব ধরনের মাটিতেই পেঁয়াজ চাষ করা যায়। তবে বেলে-দোআঁশ যুক্ত মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য বিশেষ অনুকূল। এবং ফলন ভালো হয়। পেঁয়াজ চাষের জন্য মাটির PH মান ৬-৭ থাকা ভালো।

🗓️ পেঁয়াজ চাষের সময়

পেঁয়াজ চাষ বিশেষত রবি মৌসুমে ভালো হয়। রবি মৌসুমে পেঁয়াজ চাষের উপযুক্ত সময় হল ফেব্রুয়ারি মাস ( মাঘ মাস ) উপযুক্ত। তবে খারিফ মৌসুমেও পেঁয়াজ চাষ করা যায়, খারিফ মরশুমে পেঁয়াজ চাষের উপযুক্ত সময় হল জুলাই মাস ( শ্রাবন মাস )।

🗓️ পেঁয়াজ তোলার সময়

পেঁয়াজ চারা বাপনের পর আনুমানিক ২ মাসের মধ্যে পেঁয়াজ তোলার জন্য উপযুক্ত হয়ে যায়। তবে জাত ভেদে ৫-১০ দিন এদিক ওদিক হয়ে থাকে। যখন দেখবেন গাছের পাতাগুলি প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশ শুকিয়ে নেতিয়ে গিয়েছে তখনই আপনার পেঁয়াজ গাছগুলি তোলার জন্য উপযুক্ত হয়ে যায়।

🧑‍🌾 তোলার পর করণীয়

পেঁয়াজ তোলার পর ৪-৫ সেগুলি খোলা জায়গায় রাখতে হবে। ভালো এবং খারাপ পেঁয়াজগুলিকে আলাদা করতে হবে। এরপর ভালো পেঁয়াজ গুলি গোছা গোছা বেঁধে সেগুলিকে বাড়িতে বা স্টক রুমে ঝরিয়ে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। প্রয়োজনে হিমঘরের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে সংরক্ষণের জন্য।

📝 খরচ

খরচ – যদি বলা যায় খরচের কথা তাহলে বীজ কেনা, জমিনেতে নাঙ্গল, জলসেচ, শ্রমিক, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বিষ সব মিলিয়ে ৪০-৪২ ডেসিমাল জমিতে প্রায় ১২-১৫ হাজার টাকার মত খরচ হয়ে যায় বিশেষকরে ভারতে। এবং বাংলাদেশে এই খরচ ১৯ – ২২ হাজার টাকার মতো হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *