5 আগস্ট 1911 সালে, আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা NASA সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য Juno নামে একটি মহাকাশযান লঞ্চ করে। এই মহাকাশযানটিতে অসংখ্য পরিমাণে উন্নত মানের এবং অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। যেগুলির প্রধান কাজ ছিল বৃহস্পতি গ্রহের বায়ুমন্ডলের, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির এবং চুম্বকীয় ক্ষেত্রগুলি সম্পর্কে গবেষণা করা। এই পোস্টে Juno মহাকাশযান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

Today Weather, Today temperature, Weather tomorrow, Weather 7 days,
Photo by science.nasa.gov

বৃহস্পতি গ্রহটিটিকে গ্যাসের গোলা বলা হয়ে থাকে। কারণ এটি হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম গ্যাসের সংমিশ্রণে তৈরি। বৃহস্পতি গ্রহটি পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে বৈজ্ঞানিকদের প্রায় 79টি বৃহস্পতির উপগ্রহের সন্ধান মিলেছে। যেগুলিতে বৈজ্ঞানিকেরা জল এবং আগ্নেয়গিরির সন্ধান পেয়েছে। তাই বৈজ্ঞানিকেরা অনুমান করছে বৃহস্পতির ওই সমস্ত উপগ্রহগুলিতে জীবের অস্তিত্ব থাকতে পারে। কারণ যেখানেতে জল থাকে সেখানেতে জীবের সন্ধান থাকাটাই স্বাভাবিক। 

বৃহস্পতি গ্রহটি এতটাই বড় যেখানে সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ এবং উপগ্রহগুলিও যুক্ত করলে বৃহস্পতির মতো এত বড় হবে না। আমাদের পৃথিবীর প্রায় গোলাকার আকার দেওয়ার ক্ষেত্রে সূর্যের পর, এই বৃহস্পতির বড় অবদান রয়েছে। 1970 এর দশকে বৃহস্পতি গ্রহকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিভিন্ন স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। যে গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল Pioneer-10, Pioneer-10, Voyager-1, Voyager-2 . এই সমস্ত স্যাটেলাইট গুলি বৃহস্পতি গ্রহ এবং তার উপগ্রহ গুলির নানান রহস্যময় তথ্য পৃথিবীতে থাকা বৈজ্ঞানিকদেরকে দিয়েছিল। যেগুলোর মাধ্যমে বৈজ্ঞানিকেরা বৃহস্পতি গ্রহ এবং তার উপগ্রহগুলিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিল।

গ্যালিলিও স্যাটেলাইট সম্পর্কে

এরপর 1989 সালে বৃহস্পতি গ্রহ এবং তার উপগ্রহগুলিকে আরো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য গ্যালিলিও নামে একটি স্যাটেলাইট আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা NASA লঞ্চ করে। এটি ছিল বৃহস্পতি গ্রহের প্রথম অরবিটার মিশন, অর্থাৎ এই গ্যালিলিও স্যাটেলাইটটি বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথে অবস্থান করার প্রথম স্যাটেলাইট ছিল। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথে থেকে গ্রহটি এবং তার উপগ্রহ গুলি সম্পর্কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে।

গ্যালিলিও স্যাটেলাটের কাজ

প্রায় ছয় বছরের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে গ্যালিলিও স্যাটেলাইটটি 1995 সালে বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথে অবস্থান করেছিল। এরপর প্রায় আট বছর ধরে বৃহস্পতি গ্রহ এবং তার উপগ্রহগুলিকে পর্যবেক্ষণ করেছিল। এই গ্যালিলিও স্যাটেলাইটটি বৃহস্পতি গ্রহ এবং তার উপগ্রহ ইউরোপার সমুদ্রপৃষ্ঠ, আগ্নেয়গিরি মাধ্যাকর্ষণ বলের অনুসন্ধান করেছিল।  2003 সাল পর্যন্ত স্যাটেলাইটটি বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথে ছিল এবং পর্যবেক্ষণ করেছিল। এবং মিশনটির উদ্দেশ্য সম্পন্ন হয়েছিল।

Juno মিশন সম্পর্কে বিস্তারিত

গ্যালিলিও মিশনটি বৈজ্ঞানিকদের কাছে বৃহস্পতি গ্রহ এবং তার উপগ্রহগুলিকে নিয়ে এমন রহস্য তুলে ধরেছিল, যেগুলি বৈজ্ঞানিকদের মনে অনেক প্রশ্ন তৈরি করেছিল। এবং এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার জন্যই আরও উন্নত মানের অত্যাধুনিক একটি কৃত্রিম উপগ্রহের প্রয়োজন ছিল। যেটিতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং হাই ক্যাপাসিটি যুক্ত ক্যামেরার থাকবে। যেগুলির মাধ্যমে বৃহস্পতি গ্রহের বায়ুমণ্ডল, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, গঠন এবং এর উপগ্রহগুলি সম্পর্কে যাতে  আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এবং এর জন্যই তৈরি করা হয় JUNO মহাকাশ যান।

Juno মহাকাশযানের লঞ্চিং ডেট ও প্রক্রিয়া

9ই জুন 2005 সালে juno মহাকাশযানটি সম্পর্কে পরিকল্পনা করা হয়। এরপর 2009 সালে juno মহাকাশযানটি লঞ্চ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কিন্তু বাজেট কম থাকার জন্য মিশনটির লঞ্চিং ডেটকে দু’বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। এরপর 5ই আগস্ট 2011 তে  Atlas V551 রকেটের মাধ্যমে মহাকাশে লাঞ্চ করা হয়।

এই মহাকাশযানটিকে Lockheed Martin নামের একটি কোম্পানির তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছিল। এবং এটিকে নাসার একটি মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে।

মিশনটির জন্য এনার্জির ব্যবহার 

এই মহাকাশযানটির ওজন প্রায় 36 কুইন্টাল 25 কেজির মতো ছিল। JUNO স্যাটেলাইটটি সোলার সিস্টেমে যাওয়া প্রথম স্যাটেলাইট ছিল যেটিতে এনার্জি হিসেবে সোলার প্যানেলকে ব্যবহার করা হয়েছিল। স্যাটেলাইটটিতে তিনটি বড় বড় সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হয়েছিল।

Juno মহাকাশযানে যন্ত্রপাতির বিবরণ

JUNO স্যাটেলাইটটিতে মোট 9টি পেলোড বা ইন্সট্রুমেন্ট লাগানো হয়েছিল। সেগুলি হল মাইক্রোওয়েভ রেডিওমিটার (MWR), জোভিয়ান ইনফ্রারেড অরোরাল ম্যাপার (JIRAM), ম্যাগনেটোমিটার, গ্রাভিটি সায়েন্স, আল্ট্রাভায়োলেট এক্সপেক্টরোগ্রাফ (UVS), প্লাজমা ওয়েভ ইনস্ট্রুমেন্ট (WAVES), জোভিয়ান অরোরাল ডিস্ট্রিবিউশন এক্সপেরিমেন্ট (JEDE), জুপিটার এনার্জেটিক পার্টিকেল ডিটেক্টর ইন্সট্রুমেন্ট(JEDI), জুনোকাম।

গ্রাভিটি সায়েন্স – এর কাজ হল বৃহস্পতি গ্রহের গঠন সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ করা।

ম্যাগনেটোমিটার – ম্যাগনেটোমিটারের কাজ হল বৃহস্পতি গ্রহটির মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এবং চুম্বকীয় ক্ষেত্র সম্পর্কে গবেষণা করা।

মাইক্রোওয়েভ রেডিওমিটার (MWR) – এর কাজ হল বৃহস্পতি গ্রহের বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে গবেষণা করা। সেই সঙ্গে সেখানে কত পরিমাণে জল রয়েছে, এবং জলেতে কোন অক্সিজেন রয়েছে কি না সে সম্পর্কেও পর্যবেক্ষণ করা।

JEDI , JEDE ও  WAVES যন্ত্র – এই তিনটির কাজ প্রায় একই ধরনের, যেমন বৃহস্পতি গ্রহের ইলেকট্রিক ফিল্ড সম্পর্কে নমুনা সংগ্রহ করা। এবং বৃহস্পতি গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সঙ্গে বিশেষ করে অরোরার (Auroras) ও বায়ুমন্ডলে অন্যান্য উপাদানগুলির কি সম্পর্ক রয়েছে তা অনুসন্ধান করা।

UVS ও JIRAM যন্ত্র – এই দুটি ইন্সট্রুমেন্ট এর কাজ হল আল্ট্রাভায়োলেট এবং ইনফেয়ারেড ক্যামেরা ব্যবহার করে বৃহস্পতি গ্রহের বায়ুমণ্ডল এবং অরোরার ছবি তোলা 

জুনোকাম (JunoCam) – এর কাজ হল বৃহস্পতি গ্রহের একেবারে সামনে গিয়ে বিভিন্ন উপাদানের কালার ফটো তোলা।

মহাকাশযানটির গতিপথ

লঞ্চ করার পর 2013 সালের অক্টোবর মাসে শেষবারের মতো পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেছিল এই JUNO মহাকাশ যানটি। পৃথিবীর কক্ষপথকে পেরিয়ে যাওয়ার পর, এর গতিবেগকে 125528 কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা থেকে বাড়িয়ে 149668 কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা করে দেওয়া হয়েছিল। 

Juno মহাকাশযানটিকে বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছাতে প্রায় পাঁচ বছর সময় লেগে গিয়েছিল। এবং অবশেষে প্রায় 2.8 বিলিয়ান কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে 2016 সালের 5ই জুলাই বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথে অবস্থান করে।

এরপর 2016 সালের আগস্ট মাসে এই উপগ্রহটি বৃহস্পতি গ্রহকে প্রথমবার প্রদক্ষিণ করেছিল। ওই প্রথম প্রদক্ষিনের সময় বৃহস্পতি গ্রহ এবং Juno মহাকাশযানটির মধ্য দূরত্ব ছিল মাত্র 4200 কিলোমিটার।

এরপর 2016 সালের অক্টোবর মাসে দ্বিতীয়বার প্রদক্ষিণ  করার সময় মহাকাশযানটির মধ্যেও কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এবং প্রদক্ষিণ হওয়ার প্রায় 13 ঘণ্টা আগেই মহাকাশযানটিকে সেফ মোডে রাখা হয় অর্থাৎ প্রদক্ষিণ করানো বন্ধ করা হয়। এরপর পুনরায় মেন ইঞ্জিনকে চালু করে প্রদক্ষিণ করানো শুরু করা হয়।

 এই সমস্যার জন্য যেখানে মহাকাশযানটি কুড়ি মাসের মধ্যে 37টি কক্ষপথকে অতিক্রম করার পরিবর্তে শুধুমাত্র 20টি কক্ষপথকে অতিক্রম করতে পেরেছিল। তবে সেখানেতে কঠিন রেডিয়েশন ও কঠিন পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও মহাকাশযানটির তেমন কোন ক্ষতি হয়নি।

মহাকাশযানটি সম্পূর্ণ ঠিক থাকার কারণে বৈজ্ঞানিকগণেরা এর কার্যদিনকে 2021 সালের জুলাই মাস পর্যন্ত স্থির করে। কিন্তু এই কার্যদিন গুলিতে মহাকাশযানটি পৃথিবীতে থাকা বৈজ্ঞানিকদের বিভিন্ন রহস্যময় তথ্য দিয়েছিল। যেমন   বৃহস্পতির আরোরা পৃথিবীতে আসা অরোরার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, পৃথিবী ছাড়াও বৃহস্পতি গ্রহেরও অভ্যন্তরীণ চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে, ইত্যাদি। তাই বৃহস্পতি গ্রহ এবং তার আশেপাশের উপাদানগুলিকে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য জন্য এর কাজ করার দিন বাড়িয়ে 2025 পর্যন্ত করে দেওয়া হয়। 

CONCLUSION 

এটি এমন একটি মহাকাশযান ছিল যেটি বৃহস্পতি গ্রহকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য পাঠানো অন্যান্য মহাকাশ যান গুলির পরিপূরক ছিল। এবং এটি সেই সমস্ত মহাকাশযানগুলির অসম্পূর্ণ কাজকাগুলিকে সম্পূর্ণ করেছিল। সেই সঙ্গে বৃহস্পতি গ্রহ এবং তার কক্ষপথ ও আশেপাশের বিভিন্ন উপাদান গুলি সম্পর্কে বিস্তারিত নানান তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি বৈজ্ঞানিকদের মনে নানান রহস্য তৈরি করেছিল। এইসব দিক থেকে বিচার করলে Juno মিশনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মিশন ছিল।

FAQ

পৃথিবী থেকে বৃহস্পতি গ্রহের দূরত্ব কত?

পৃথিবী থেকে বৃহস্পতি গ্রহের দূরত্ব প্রায় 770,181,9434 কিলোমিটার।

Juno মহাকাশযানটি কবে লঞ্চ করা হয়েছিল?

2011 সালের 5ই আগস্ট মাসে juno মহাকাশযানটিকে লঞ্চ করা হয়েছিল Atlas V551 রকেটের সাহায্যে।

বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথে পৌছাতে Juno মহাকাশযানটি কতদিন সময় লেগেছিল?

বৃহস্পতির কক্ষপথে পৌঁছাতে Juno মহাকাশযানটির প্রায় পাঁচ বছর সময় লেগেছিল।

Juno মহাকাশযানটিতে জ্বালানি হিসেবে কি ব্যবহার করা হয়েছিল।

Juno মহাকাশযানটিতে জ্বালানি হিসেবে কোন তরল বা গ্যাসীয় পদার্থ ব্যবহার করা হয়নি। এখানেতে সৌর শক্তির মাধ্যমে এনার্জি পাওয়ার জন্য সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হয়েছিল।

বৃহস্পতি গ্রহের রং কি রকম?

বৃহস্পতি গ্রহটি হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম গ্যাসে পরিপূর্ণ। এটির রং অনেকটা লাল-বাদামি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *