বন্ধুরা, আপনি মনে করেন ৩০০ কিলোমিটার উচ্চতা বিশিষ্ট একটি টাওয়ার তৈরি করেছেন। ওই টাওয়ারের ওপর থেকে যদি একটি বস্তু ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে সোজাসুজি নিচে গিয়ে পড়বে, আবার ওই বস্তুটিকে যদি একটু জোরে ছুড়েন তাহলে বস্তুটি কিছুটা বেঁকে গিয়ে দূরে পড়বে। কিন্তু মনে করেন যদি আপনি বস্তুটিকে ৪০,৩০০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টার গতিবেগে ছুড়েন, তাহলে বস্তুটি কোনদিনই পৃথিবীতে ফিরে আসবেনা, অর্থাৎ এটি পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের বাইরে চলে যাবে।
আবার, বস্তুটিকে যদি আপনি প্রায় প্রতি ঘন্টায় ২৮ হাজার কিলোমিটার গতিবেগে ছুড়েন, তাহলে বস্তুটি পৃথিবীর বক্রপথে ফিরে আসার চেষ্টা করবে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে বস্তুটির বক্রপথ পৃথিবীর বক্রতার সমান হয়ে যাবে। ফলে বস্তুটি মুক্তভাবে পড়বে ঠিকই কিন্তু প্রতিক্ষেত্রে বস্তুটি পৃথিবীকে মিস করবে, অর্থাৎ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকবে।
সুতরাং কোন বস্তুকে নির্দিষ্ট উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে, নির্দিষ্ট গতি দিতে পারলে বস্তুটির গতিবেগে যে ইউনিক বৈশিষ্ট্য দেখা যাবে, তা থেকে বিভিন্ন সুবিধা নেওয়া সম্ভব হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন বস্তুকে নির্দিষ্ট উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে, নির্দিষ্ট বেগ কিভাবে দেওয়া সম্ভব। তখনই আমাদের সামনে আসে রকেট সাইন্স।
একটি বেলুন ফুলিয়ে ওপরে ছেড়ে দিলে কি ঘটে। বেলুন টির যেদিক থেকে বাতাস বার হয়, বেলুনটি তার বিপরীত দিকে গতিশীল থাকে। এই প্রক্রিয়াটির গাণিতিক ব্যাখ্যা হচ্ছে, প্রত্যেকটি ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্রিয়া থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার প্রতিক্রিয়া থাকবে। যাকে বলা হয়, স্যার আইজ্যাক নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র।
রকেট এই বেলুনের মতোই কাজ করে, তবে পার্থক্য হচ্ছে, বেলুনের গতিবেগ আনপ্রেডিক্টেবল, অপরদিকে রকেটের গতিবেগ নিয়ন্ত্রিত এবং প্রেডিক্টেবেল। যেকোনো রকেটেরই মোট ওজনের ৯০% থাকে জ্বালানি, কারণ নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী আমরা জানি F = ma । অর্থাৎ কোন বস্তুর ভর যত বেশি হবে, সেটির মধ্য ত্বরণ সৃষ্টি করতে তত বেশি বল বা ফোর্স প্রয়োজন হবে।
যে রকেটের মাধ্যমে James Webb Space Telescope কে স্পেসে পাঠানো হয়েছিল তার নাম হলো Ariane-5 । এই Ariane-5 রকেটের যে ওজন ছিল তা হল ৮৫০ টন। তাহলে ভাবুন কোনো ৮৫০ টন ওজনের বস্তুকে ওপরে তুলতে কতটাই না শক্তির প্রয়োজন হবে। এই কারণেই রকেটের মোটো ওজনের নব্বই শতাংশই থাকে জ্বালানি।
রকেটে দুই ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। কঠিন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় অ্যালুমিনিয়াম পাউডার এবং অ্যামোনিয়াম পারক্লোরাইড, এদের পারস্পরিক বিক্রিয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচুর পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন হয়। যার কারনে রকেটের দুই সাইডে থাকা বুস্টারে প্রচুর পরিমাণে কঠিন জ্বালানি ব্যবহার করা হয়।
Ariane-5 এর দুই পাশে থাকা দুটি বুস্টারের প্রত্যেকটিতেই প্রায় ২৪১ টন করে কঠিন জ্বালানি ছিল। তবে এখানে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই ২৪১ টন জ্বালানি মাত্র ২ মিনিটেই পুড়ে যায়, কিন্তু এই দুই মিনিটেই রকেট প্রায় ৬৫ কিলোমিটার ওপরে উঠে যায়। বুস্টারের জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর, বুস্টার দুটি রকেট থেকে আলাদা হয়ে যায়। এবং সমুদ্রে পতিত হয় বৈজ্ঞানিকদের দ্বারা। পরবর্তীকালে ওই বুস্টার দুটিকে সমুদ্র থেকে সংগ্রহ করা হয় পুনরায় অন্য কোন রকেটে ব্যবহার করার জন্য।
অন্যদিকে প্রধান রকেটে ব্যবহার করা হয় তরল জ্বালানি, অর্থাৎ লিকুইড ফিউল। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় হাইড্রোজেন। প্রকৃতিতে সবচেয়ে হালকা উপাদান হচ্ছে হাইড্রোজেন , স্বাভাবিক তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন গ্যাস অবস্থায় থাকে, ফলে হাইড্রোজেনকে ঠান্ডা করে অর্থাৎ এর তাপমাত্রাকে কমিয়ে তরলে পরিণত করা হয়। হাইড্রোজেন গ্যাসকে তরলে পরিণত করার জন্য প্রায় -২৫৩°C সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়। যাতে করে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেন রকেটে ভরা যায়।
তবে রকেট যত ওপরে যেতে থাকবে, ততই অক্সিজেনের মাত্রা ধীরে ধীরে কমতে থাকবে, আর স্পেসেতো অক্সিজেন একেবারেই থাকে না। আর অক্সিজেন না থাকলে হাইড্রোজেনের প্রতিক্রিয়াও হবে না, ফলে রকেটে আলাদা করে অক্সিজেন দিয়ে দেওয়া হয়। আর অক্সিজেনকেউ হাইড্রোজেনের মতো তরল করে রকেটে দেওয়া হয়। অক্সিজেন -১৮৩°C সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরলে পরিণত হয়।
হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় জল এবং শক্তি উৎপন্ন হয়। তাই রকেটের পেছন থেকে আমরা যে ধোঁয়া বের হতে দেখি, ওগুলি আসলে জলীয় বাষ্প।
এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, রকেটের মধ্যে যে বিশাল পরিমাণ বিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তার ফলে রকেটে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদান গুলিতো গলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তবুও গলে না।
বিশাল তাপে রকেট গলে যায় না কেন
রকেটের মেন ইঞ্জিনে যখন হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন ইনজেক্ট করা হয়, তখন উভয়ের বিক্রিয়ার ফলে তাপমাত্রা প্রায় ৩৩০০°C এর কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এই তাপমাত্রায় রকেটে যে মেটাল ব্যবহার করা হয়, তা গলে যাওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে এমনটা হয় না। কারণ এক্ষেত্রে আশ্চর্যজনক কুলিং সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। নজেলের বাইরে এবং ভেতরের দিকে চিকন চিকন পাইপ থাকে, এই পাইপ গুলোতে রকেটের মধ্যে -২৫৩°C তাপমাত্রায় থাকা হাইড্রোজেনকে প্রবাহিত করা হয়। ফলে এত উচ্চ তাপমাত্রাতেও রকেটের নজেল ঠান্ডা থাকে।
প্রধান রকেটের জ্বালানি যখন শেষ হয়ে যায়
যাই হোক মেইন রকেটের জ্বালানি যখন শেষ হয়ে যায়, তখন সেটিও আলাদা হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রকেট থেকে বুস্টার কখন আলাদা হবে, বা প্রধান ইঞ্জিন কখন আলাদা হবে, এগুলি কি পৃথিবীতে বসে বৈজ্ঞানিকরা নিয়ন্ত্রণ করে? এর উত্তর হলো না।
এই বিষয়গুলো মূলত নিয়ন্ত্রিত হয় রকেটের মধ্যে থাকা কম্পিউটারের মাধ্যমে। এর জন্য রকেটের মধ্যে তিনটি কম্পিউটার রাখা হয়, কারণ একটি যদি কাজ না করে তাহলে দ্বিতীয়টি যেন অটোমেটিক্যালি কাজ করা শুরু করে দেয়, কিন্তু কারণবশত যদি দ্বিতীয় কম্পিউটারটিও কাজ না করে সেক্ষেত্রে যেন তৃতীয় কম্পিউটারটি কাজ করে, এর জন্য বিশেষ সতর্কতা স্বরূপ তিনটি কম্পিউটার রাখা হয়।
এই কম্পিউটারগুলি যে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন এমনটা কিন্তু নয়। এগুলি আমাদের হাতে থাকা স্মার্টফোন গুলির মতোই ক্ষমতাসম্পন্ন। এই কম্পিউটার গুলিকে মূলত রাখা হয় জ্বালানির একেবারে উপরিস্তরে অর্থাৎ আগের দিকে। এর একেবারে আগে অর্থাৎ পুরোপুরি উপরের দিকে থাকে প্রধান জিনিস, যেটিকে স্পেসে পাঠানো হবে।
বুস্টার এবং মেন ইঞ্জিন আলাদা হয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট স্পেসে পাঠানো অংশটি যাতে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারে তার জন্য তাতে অন্য একটি ইঞ্জিন লাগানো হয়।
রকেট উপরে ওঠার সময় ভারসাম্য কিভাবে বজায় রাখে
দেখুন আমরা যদি একটি ব্যাটকে, এক আঙুলের উপরে দাঁড়িয়ে রাখানোর চেষ্টা করি, তাহলে ব্যাটটি যাতে পড়ে না যায় ব্যাটটির ভারসাম্য অনুযায়ী আমরা হাত বা আঙুলটিকে ব্যাটের ভরকেন্দ্রের দিকে করে থাকি। রকেটের ক্ষেত্রে এই কাজটি করে নজেল। নজেলটি সক্রিয় থেকে বিভিন্ন দিকে বাঁকতে পারে। যার মাধ্যমে রকেটের ভারসাম্য বজায় থাকে।
আপনারা অনেকেই হয়তো space shuttle এর নাম শুনেছেন। এই space shuttle এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলি স্পেসে গিয়ে নির্দিষ্ট কাজ শেষ করে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে। এই জটিল বিষয়টিকে সম্ভব করেছিল নাসা। নাসা গত ৩০ বছরে ১৩৫টি মিশন সফল করেছে এই স্পেস স্যাটেলের দ্বারা। ২০১১ সালে সর্বশেষ space shuttle ব্যবহার করা হয়েছিল।
space shuttle এর দুপাশের বুস্টারে অন্যান্য রকেটের মতোই সলিড ফুয়েল ব্যবহার করা হয়। এবং মাঝখানে যে কমলা রঙের বড় অংশ থাকে, সেটিতে তরল জ্বালানি থাকে। এবং space shuttle এ এক ধরনের উড়োজাহাজ আকৃতির অংশ থাকে, যেটিতে বিভিন্ন বস্তুগুলিকে রাখা হয়। যেগুলিকে স্পেস এ পাঠানো হবে। হাবল স্পেস টেলিস্কোপটিকে এই space shuttle এর মাধ্যমেই স্পেসে নিয়েই যা হয়েছিল।
space shuttle এর অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয় হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন বিক্রিয়ার মাধ্যমে। এবং এই বিক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন জল অ্যাস্ট্রোনডরা তাদের খাবারের জল হিসেবে ব্যবহার করে। সেইসঙ্গে স্পেস থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানিও তাতে সঞ্চয় করে রাখা হয়। এই গেল একটি রকেট কিভাবে কাজ করে তার একটা সাধারণ সারসংক্ষেপ।
রকেটকে লঞ্চ করার সময় যে যে পদক্ষেপই গ্রহণ করতে হয়
একটি রকেটকে লঞ্চ করার সময় অনেক পদক্ষেপই গ্রহণ করতে হয়। রকেট লঞ্চপ্যাড তৈরি করার সময় নানান দিক লক্ষ্য রেখে তৈরি করতে হয়। রকেট ইঞ্জিন যখন স্টার্ট হয় ,তখন প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প তৈরি হয়, এই বিপুল পরিমাণ জলীয় বাষ্প লঞ্চ করার সময় লাঞ্চপ্যাড থেকে যাতে খুব তাড়াতাড়ি সরে যায়, তার জন্য লাঞ্চপ্যাডের নিচে এক ধরনের কতগুলি হলের মতো তৈরি করা হয়, যাতে তাড়াতাড়ি লঞ্চ প্যাড থেকে দূরে সরে যায় এবং রকেট সুরক্ষিত থাকে।
একটি রকেট লঞ্চ করার সময় অকল্পনীয় বিকট শব্দ সৃষ্টি হয়, যা পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত দূরে থেকেও শব্দের অনুভব করা যায়। এই মারাত্মক পরিমাণে শব্দ শক্তি ফ্লোরে প্রতিফলিত হয়ে রকেটের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে, তাই এই শব্দকে নিয়ন্ত্রিত করা খুবই জরুরী। এই কাজটি করা হয় জলের মাধ্যমে, কারণ ওয়াটার বাবুল নয়েজ ক্যান্সলেশনের জন্য খুব ভালো কাজ করে।
এই কারণে রকেট লঞ্চ করার পূর্ব মুহূর্তে রকেটের লঞ্চ প্যাডে প্রচুর পরিমাণে জল নিক্ষেপ করা হয়। এই জল থেকে প্রচুর পরিমাণে ওয়াটার বাবুল বা জলের ফেনা তৈরি হয়। যা লঞ্চ প্যাডের চারপাশে ভাসতে থাকে। এই ওয়াটার ববুলের ফলে রকেট লঞ্চ করার সময় লঞ্চপ্যাডে যে শব্দ উৎপন্ন হয়, সেই শব্দগুলি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এবং রকেট শব্দের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পায়।
এই ধরনের একই টেকনিক সাবমেরিনের জন্যও ব্যবহার করা হয়। যেন শব্দের মাধ্যমে সাবমেরিনকে ডিটেক্ট করা না যায়।
যাইহোক যে কোন রকেটের লঞ্চ প্যাডগুলো মূলত বিষুবরেখা বরাবর বা তার আশেপাশে তৈরি করা হয়। কারণ পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে মেরু অঞ্চলে ঘূর্ণনের স্পিড সবথেকে কম। এবং বিষুবরেখা অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। তাই বিষুব অঞ্চলে যে কোন বস্তুই ঘন্টায় প্রায় ১৬৫০ কিলোমিটার গতিবেগ পেয়ে থাকে।
এখন রকেট যদি বিষুব অঞ্চল থেকে লঞ্চ করা হয়। তবে তা পৃথিবীর ঘূর্ণনের সর্বোচ্চ শক্তি পাবে, যার ফলে তুলনামূলক কম জ্বালানি খরচ হবে, এবং এগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আপনারা আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করবেন, যেকোনো রকেট লঞ্চ করার পর সেগুলি স্ট্রেট বা পুরোপুরি সোজাসুজি ওঠে না । কিছুটা সময় পর সেটি পৃথিবীর ঘূর্ণন বরাবর বেঁকে যায়। এবং পৃথিবীর ঘূর্ণন বরাবর বেঁকে যাওয়ার ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণনের সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়ে আরবিটে যেতে পারে।
এবং যেকোনো রকেট লঞ্চ করার পর ধীরে ধীরে তার জ্বালানি কমতে থাকে, এর ফলে রকেটের ভার বা ওজনও অনেকটা কমতে থাকে, যার ফলে রকেটের গতিবেগও প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। এর ফলে যে কোন রকেটই তার স্যাটেলাইটকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নির্দিষ্ট গতিতে পৌঁছাতে পারে।
ওপরেতে এখন পর্যন্ত রকেটের মূল অংশগুলো বলা হয়েছে, কিন্তু এগুলো ছাড়াও একটি রকেটকে সফলভাবে লঞ্চ থেকে তার গন্তব্যস্থলে সফলভাবে পৌঁছানো পর্যন্ত অনেক ছোটখাটো বিষয় রয়েছে। যেগুলিকে সঠিক নিয়ম মেনে ১০০% আকিউরিসি ভাবে সম্পন্ন করতে হয়। আসলে একটি রকেটের মেকানিজম বিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং একটি বিষয়। সেই সঙ্গে খুবই কর্মসাপেক্ষ।
অরবিট মেকানিজম কি
চলুন এখন অরবিট মেকানিজম সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক। যেকোনো ন্যাচারাল বা আর্টিফিশিয়াল রকেটকে কোন একটি নির্দিষ্ট অরবিটে থাকতে হলে, কতটা বেগপ্রাপ্ত হতে হবে কিংবা সেটি কত সময়ে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করবে, তা সম্পূর্ণ গাণিতিক বিষয়। তাছাড়া কোন স্যাটেলাইটকে এক অরবিট থেকে অন্য আরবিটে যেতে হলে কোন পজিশন থেকে কতটা এনার্জি বুস্ট করতে হবে, এগুলো সম্পূর্ণ একটি গাণিতিক বিষয়। এক্ষেত্রে কেপলারের কক্ষপথের তিনটি সূত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে সরাসরি গাণিতিক বিষয়টিকে আলোচনা না করে, চলুন সহজ ভাষায় জানা যাক, দেখুন কোন একটি স্যাটেলাইটের অরবিট যদি বৃত্তাকার হয়, তাহলে স্যাটেলাইটের বেগ সব সময় একই থাকবে। কিন্তু স্যাটেলাইটের অরবিট যদি উপবৃত্তাকার হয়, তাহলে স্যাটেলাইট যখন পৃথিবীর সবচেয়ে সামনে থাকবে তখন তার গতি সর্বাধিক হবে। অপরপক্ষে স্যাটেলাইট এবং পৃথিবীর দূরত্ব যত বেশি হবে, স্যাটেলাইটের গতিবেগও তত কম হবে।
কোন একটি স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে যত দূরে থাকবে, সেটির অরবিটও তত বড় হবে, এবং সেই স্যাটেলাইটের স্পিড তুলনামূলক কম হবে। এখন মনে করুন কোন একটি স্যাটেলাইট পৃথিবীকে বৃত্তাকার পথে প্রদক্ষিণ করছে, এমন ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট টিকে আবার আরবিটে নিতে চাইলে যেকোনো পজিশন থেকেই স্যাটেলাইটটিকে বুস্ট-আপ করতে হবে অর্থাৎ এর স্পিড বাড়াতে হবে।
এরফলে অরবিটের আকৃতি কিছুটা উপবৃত্তাকার হবে। এরপর স্পিডকে কিছুটা কমাতে হবে, এবং উপবৃত্তাকার পথের সর্বোচ্চ পয়েন্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নতুন অরবিটের সর্বোচ্চ অংশে পৌঁছানোর পর, পুনরায় স্যাটেলাইটের গতি বাড়াতে হবে, যাতে অরবিটের আকৃতি উপবৃত্তাকার থেকে বৃত্তাকার হয়ে যায়। এই ভাবেই স্যাটেলাইট লোয়ার অরবিট থেকে আপার অরবিটে যেতে পারে।
আবার স্যাটেলাইটটিকে লোয়ার অরবিটে নিয়ে আসার জন্য একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে স্যাটেলাইটের গতিবেগ বাড়ানোর পরিবর্তে কমানো হয়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট পয়েন্টে গিয়ে গতি কমাতে হয়।
কিন্তু কোন পয়েন্টে গিয়ে গতি বাড়াতে হবে বা কোথায় গিয়ে গতি কমাতে হবে তা যদি মেন্টেন করা না হয়, অর্থাৎ যদি গন্তব্যস্থল অনুযায়ী সারাক্ষণ স্পিড আপ বা গতি বাড়িয়ে রাখা হয় তাহলে রকেটটি একসময় পৃথিবীতে এসেই পড়বে।
যাই হোক মনে করুন একটি স্যাটেলাইট উপবৃত্তাকার কক্ষপথে রয়েছ, এটি যদি আপার অরবিটে যেতে চাই, তাহলে কিছু গাণিতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে এবং অল্প জ্বালানি খরচ করে যেতে পারে। উপবৃত্তাকার কক্ষপথের যে অংশটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে তাকে বলে PERIGEE , এবং যে অংশটি সবচেয়ে দূরে থাকে তাকে বলে AP0GEE ।
এখন স্যাটেলাইটটি যদি আপার অরবিটে যেতে চাই তাহলে PERIGEE পয়েন্টে এসে স্পিড আপ বা গতি বাড়ালে, খুবই অল্প জ্বালানি খরচ করে আপার অরবিটে যাওয়া যায়। কারণ PERIGEE পয়েন্টে গতিবেগ এমনিতেই বেশি থাকে, সেই জায়গায় অল্প গতিবেগ বাড়ালেই আপার অরবিটে যাওয়া যায়।
এই ধরনের হিসাব নিকাশ যে শুধুমাত্র স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রে করা হয় তা কিন্তু নয়। যেকোনো স্পেস মিশনের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।
চাঁদের গতিবেগ শূন্য হয়ে গেলে কি ঘটবে
চলুন এবার একটি ইন্টারেস্টিং বিষয় জেনে নেওয়া যাক, ধরুন চাঁদের গতিবেগ যদি একেবারে শূন্য হয়ে যায় বা কোনভাবে শূন্য করে দেওয়া হয় তাহলে কি ঘটবে? উত্তর হল, চাঁদটি পুরোপুরি ভাবে পৃথিবীতে এসে নিক্ষেপ হবে। কারণ চাঁদের গতিবেগ না থাকার কারণে এটি অরবিটকে মেন্টেন করতে পারবেনা, ফলে এই চাঁদের ওপর অভিকর্ষ শক্তি যার বেশি তার উপরে এসে নিক্ষেপ হবে।
Conclusion
আমরা প্রতিনিয়ত স্পেসে স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছি, যা আমাদের জীবন ও যোগাযোগকে আরও সহজ করছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে চাঁদ, সূর্যে ও মঙ্গল গ্রহে স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন দেশ গভীর সমুদ্রে স্যাটেলাইট পাঠানোর জন্য নানান পরিকল্পনা করছে। যাই হোক স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য আমাদেরকে নানান দিকের পূর্বাভাস দিয়ে থাকে, এবং নানান জ্ঞান অর্জনের সাহায্য করে। যে আমাদের দৈনন্দিন ভাবে প্রয়োজন।
FAQ
রকেটে দুই ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। কঠিন এবং তরল। কঠিন জ্বালানি হিসেবে অ্যালুমিনিয়াম পাউডার ও অ্যামোনিয়াম পারক্লোরাইড। এবং তরল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় হাইড্রোজেন।
স্যাটেলাইট কি বাংলা ভাষায় কৃত্রিম উপগ্রহ বলা হয়।
পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি বিষুব অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি থাকে। এবং মেরু অঞ্চলে সবচেয়ে কম থাকে।