বন্ধুরা, ২০২১ সালে গুজরাটের ঢোলাবিরা অঞ্চলকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের দরজা দেওয়া হয়েছিল। যা ইউনিয়ন মিনিস্টার জি. কিসান রেন্ডি বলেছিলেন। এবং ভারতে আরো দশটি স্থান ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের দরজা পাবে এও তিনি উল্লেখ করেছিলেন।
২০২১ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে মোট হেরিটেজ স্থানের ( world heritage place in india) সংখ্যা ৪০ টি। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্থানের (world heritage place) সংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে, ভারত ষষ্ঠ স্থান দখল করে আছে। প্রথম স্থান দখল করে আছে ইটলি, যেখানে মোট হেরিটেজেবল স্থানের সংখ্যা ৫৭ টি, দ্বিতীয় স্থানে আছে চাইনা (৫৫টি), তৃতীয়তে রয়েছে স্পেন (৪৯টি), চতুর্থ স্থানে রয়েছে জার্মানি (৪৬টি), পঞ্চম স্থানেতে আছে ফ্রান্স (৪৫টি)। এরপরে ষষ্ঠ নম্বরে ভারত।
এখন খুব বড় একটি খবর পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে ভারতের আরও একটি স্থানকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের দরজা দেওয়া হচ্ছে, সেটি হল রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের বাড়ি। এই জায়গাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা, কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনের প্রায় বেশিরভাগ সময়টাই এই শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছে। এবং ইউনেস্কো এই শান্তিনিকেতনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্থান হিসেবে ঘোষণা করে। এটি ভারতবাসীর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বহু সময় ধরেই এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়াস চলছিল, যা ফাইনালি সম্পূর্ণ হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় একটি ছোট্ট গ্রাম রয়েছে, যেটির নাম শান্তিনিকেতন। ইউনেস্কো তার টুইটার হ্যান্ডেলে শান্তিনিকেতনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্থান হিসেবে প্রথম introduce করেন, পরবর্তীকালে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই বিষয়ে মানুষকে অবগত করেন।
ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্ট বলতে কী বোঝায়
তো দেখুন বিভিন্ন আলাদা আলাদা জায়গার বিভিন্ন লিস্ট হয়ে থাকে, যেমন আর্কিটেকচারের লিস্ট, যা ইউনেস্কোর দ্বারা তৈরি করা হয়ে থাকে। এই লিস্টগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, কারণ এর কালচারেল এবং ফিজিক্যাল দিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ । যদি আমরা শান্তিনিকেতনের কথা বলি, তাহলে এর গুরুত্ব অন্যান্য জায়গার থেকে আলাদা হয়ে থাকে। তাই বিশেষ বিশেষ গুণ সম্পন্ন এই ধরনের স্থানগুলির হেরিটেজিবল লিস্ট তৈরি করা হয়ে থাকে।
এই লিস্ট গুলোকে কে তৈরি করে থাকে
তো দেখুন এর জন্য একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি থাকে, যারা এই লিস্টকে মেনটেন করে থাকে। অর্থাৎ লিস্টে জায়গাগুলোকে যুক্ত করে থাকে।
জায়গাগুলোকে হেরিটেজ লিস্টে সংযুক্ত করে কি হবে
বিশেষত যে সমস্ত জায়গাগুলি পুরো বিশ্বে কালচারাল এবং ন্যাচারাল হেরিটেজ, সেগুলিকে পুরো বিশ্বের মানুষের সঙ্গে পরিচিত করানো, সেগুলিকে সংরক্ষণ করা, ও যাতে বিলুপ্ত থেকে বাঁচানো যায়। এবং ওই সমস্ত জায়গাগুলিকে মানুষের মধ্যে যাতে ভ্যালু তৈরি করা যায়।
বন্ধুরা, বর্তমানে ইউনেস্কোর ৪৫ টি সেশন রয়েছে, এবং এই ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটিতে ২৪ জন সদস্য রয়েছে। যেটি বর্তমানে সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত হয়েছে ১০ই সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এবং ১৬ সেপ্টেম্বরের পর বিশ্বের অনেক জায়গাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্টে ( world heritage list unesco ) সংযুক্ত করা হচ্ছে, যার মধ্যে ভারতের শান্তিনিকেতন রয়েছে।
নাম চেঞ্জ করে শান্তিনিকেতন কিভাবে হলো
তো দেখুন, শান্তিনিকেতন আগে ভুবাদাঙ্গা নামে পরিচিত ছিল। যা বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবার দেওয়া নাম ছিল। কিন্তু এর নাম পরিবর্তন করে শান্তিনিকেতন রাখা হয়েছিল। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে পিতাজী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পশ্চিমবঙ্গ থেকে রায়পুর যাচ্ছিল, রায়পুর যেতে যেতেই এই জায়গা উনি দেখতে পেয়েছিলেন, এই জায়গাটি লাল মাটি এবং ললাট ধানে ভর্তি হয়েছিল। তখনই তিনি ভেবেছিলেন এই জায়গাতে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করবেন।
পরবর্তীকালে সেখানে তিনি একটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন, যেটির নাম দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন অর্থাৎ ‘শান্তির ঘর বা শান্তির জায়গা’। পরবর্তীকালে এই ঘর তৈরি করার পর এই ঘরের নাম অনুযায়ী জায়গাটির নামকরণ করা হয় শান্তিনিকেতন, যেটি ভুবাদাঙ্গা নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল।
এর পরিবর্তে কালে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীর্ঘ ৪৮ বছর পর ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে একটি বিদ্যালয়ের স্থাপন করেন। এবং ওই বিদ্যালয়টির নাম দেওয়া হয় ‘ব্রহ্মচারী আশ্রম’। এই বিদ্যালয়টি ভারতীয় গুরুকুল সিস্টেমের সাপেক্ষে চলা শুরু করে। এর পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে রেসিডেন্টিয়াল স্কুল স্থাপিত হয়। যা ভারতীয় পুরনো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকে তুলে ধরার কাজ করেছিল।
পরবর্তীকাল ১৯২১ সালে ওই ‘ব্রহ্মচারী আশ্রমটিকে’ আপগ্রেড করে বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তর করা হয়। যার নাম দেওয়া হয় ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’ বা ‘ওয়ার্ড ইউনিভার্সিটি, বলা যেতে পারে। ওই সময় ভারত কিন্তু ইংরেজদের শাসনে ছিল। কিন্তু তা সত্বেও ইউরোপিয়ান কালচারকে অস্বীকার করে এখানেতে এশিয়ান কালচারে পড়াশোনা চালানো হতো। এবং এশিয়ান সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অন্যান্য বিষয়গুলি এখানে অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই ‘বিশ্বভারতী ইউনিভার্সিটি’ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে একটিমাত্র ইউনিভার্সিটি, যেটি সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি। এই সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির চান্সেলার হলেন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং ভাইস চ্যান্সেলর হচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের গভর্নর। কেননা ভারতে যতগুলো কেন্দ্রীয় ইউনিভার্সিটি রয়েছে, সেগুলির প্রত্যেকটিতে চ্যান্সেলর হয়ে থাকেন প্রধানমন্ত্রী এবং ভাইস চ্যান্সেলর হয়ে থাকেন ওই রাজ্যের রাজ্যপাল, বিশেষত যে রাজ্যে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়টি থাকে।
২০২০ সালে যে নতুন এডুকেশনাল পলিসি ইন্ট্রোডিউস করেছিল ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি (NEP-২০২০) , সেটির পরিপ্রেক্ষিতে অমিত শাহ বলেছিলেন, নতুন যে এডুকেশন পলিসি নিয়ে আসা হচ্ছে, তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের এডুকেশনাল মডেলকে সামনে রেখেই তৈরি করা হচ্ছে।
শান্তিনিকেতন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্থান পাওয়ার প্রক্রিয়া
শান্তিনিকেতনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্থান দেওয়ার জন্য ২০১০ থেকে সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে। কারণ ২০১০ সালেই তৎকালীন কেন্দ্র সরকার দ্বারা প্রথম এপ্লাই করা হয়েছিল যাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্থান দেওয়া যায়। কিন্তু ওই সময় প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যায়।
পরবর্তীকালে ২০২১ সালে পুনরায় শান্তিনিকেতনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্থান দেয়ার জন্য আবেদন করা হয়। এর জন্য আর্কিলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, বিশ্বভারতী অথরিটির প্রচেষ্টায় নানান ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে একটি রিপোর্ট তৈরি করেন, এবং ওই রিপোর্ট সম্বলিত প্রোপজালটি ইউনেস্কোতে সাবমিট করেন।
তাছাড়া, শান্তিনিকেতনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের দরজা দেওয়ার আরেকটি কারণ ছিল ICOMOS ( international council on monuments and sites ) এর রেকমেন্ডেশন। এটি ফ্রান্সের একটি সংস্থা, যা বেসরকারি ইন্টারন্যাশনাল একটি অর্গানাইজেশন। এটির কাজ হল ইউনেস্কোর মতোই সারা বিশ্বের যেখানে যেখানে আর্কিটেকচারেল এবং ল্যান্ডস্কেপ হেরিটেজ রয়েছে সেগুলিকে খুঁজে বার করা, এবং মানুষের কাছে তার পরিচিতি ঘটিয়ে সংরক্ষণ করা। সাধারণত ICOMOS এই বিষয়ে ইউনেস্কোকে রিকমেন্ডেশন দিয়েছিল, যাতে শান্তিনিকেতনকে এই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্টের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অর্থাৎ এই সমস্ত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনেস্কো এই বিষয়ে যাচাই করে এবং শান্তিনিকেতনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করে। আর করাটাও জরুরী ছিল, কারণ শান্তিনিকেতন এমন একটি জায়গা যেখানে শান্ত-স্নিগ্ধ-মনোরম পরিবেশ বিরাজ করে। এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি শুধুমাত্র ভারতীয় কবি হিসেবে পরিচিত নয়, তিনি সারা বিশ্বের তথা বিশ্ব কবি নামে পরিচিত, তাই তার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শান্তিনিকেতন অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি নিদর্শন। এই শান্তিনিকেতনের সঙ্গে জড়িয়ে আছি বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর আত্মা।
conclusion
যাইহোক, বিশ্বের যে সমস্ত জায়গায় এই ধরনের স্মৃতিসৌধ, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কৃতকার্য, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য, শিল্পকলা ও চিত্রলিপি ইত্যাদি হেরিটেজিবল স্থান গুলি রয়েছে। সেগুলিকে অবশ্যই বিচার বিবেচনা সাপেক্ষে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যাতে মানুষ ওই সমস্ত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ যুক্ত স্থানগুলি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারে এবং বুঝতে পারে। ও এগুলি সংরক্ষণ করা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাও মানুষ উপলব্ধি করতে পারে।
কারণ, ওই স্থান গুলিকে মানুষ যত পরিদর্শনে যাবে তত স্থানগুলির গুরুত্ব মানুষের কাছে আরও বেড়ে উঠবে, এবং মানুষের মধ্যেও জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি ইত্যাদির বিকাশ ঘটবে।
FAQ
শান্তিনিকেতন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলায় অবস্থিত ?
বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে অবস্থিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। যেটি বর্তমানে একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেও পরিচিত।
শান্তিনিকেতন বিখ্যাত কারণ এর সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়টি ব্রহ্মচারী আশ্রম হিসেবে পরিচিত। কারণ ‘ব্রহ্মচারী আশ্রম’ এর নাম পরিবর্তন করে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় রাখা হয়েছিল।